চাঁপাইনবাবগঞ্জে অধ্যক্ষ এনামুল হক ফিটুর ৪র্থ মৃত্যু বার্ষিকী আগামীকাল

ডি এম কপোত নবী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ :
চাঁপাইনবাবগঞ্জের মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক ও গবেষক একাত্তরের রণাঙ্গনের বীর যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা ও সমাজসেবী মরহুম অধ্যক্ষ এনামুল হক (ফিটু) এর ৪র্থ মৃত্যুবার্ষিকী আগামীাল ২৫ অক্টোবর বুধবার।
১৯৫৩ সালের ৪ জুলাই চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার উজিরপুর ইউনিয়নের গঙ্গাধরপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা ইদ্রিশ আহমেদ ও মাতা তাজেনুর খাতুন।
৬৯ এর ঐতিহাসিক গণঅভ্যুত্থান, ৭০ এর সাধারণ নির্বাচন, ৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধসহ স্বাধীন বাংলাদেশের সকল গণতান্ত্রিক আন্দোলনে রয়েছে বীর যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা অধ্যক্ষ এনামুল হক ফিটুর সক্রিয় অংশগ্রহণ।
স্কুল-কলেজ জীবন থেকেই তিনি বাংলাদেশ ছাত্রলীগের প্রগতিশীল রাজনীতির সাথে জড়িত। উত্তরবঙ্গের তৎকালীন তুখোড় ছাত্রনেতা নুরুল ইসলাম ঠান্ডুর হাত ধরে ১৯৬৯ সালে রাজশাহী কলেজ শাখা ছাত্রলীগের রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হোন। পরবর্তীতে রাজশাহী শহর ছাত্রলীগের কার্যকরী কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত হোন। ১৯৭০ সালে রাজশাহী কলেজ ছাত্র সংসদে ছাত্রলীগের প্রার্থী হিসেবে বয়েজ কমনরুমের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হোন।
১৯৭১ সালে মুক্তিবাহিনীর সদস্য হিসেবে মালদহ গৌড় বাগানে এবং ভারতের জলপাইগুড়ি, শিলিগুড়ি, পানিঘাটা (বাগডোগরা এয়ারপোর্ট এর কাছে )-ভারী হালকা অস্ত্রের প্রশিক্ষণ সহ বিভিন্ন মাইন বোম এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গেরিলা প্রশিক্ষণ একমাস গ্রহণ করেন ট্রেনিংপ্রাপ্ত হোন এবং প্লাটন কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেন। পরবর্তীতে ভারতের প্রভৃতি এলাকায় ভারতীয় সেনাবাহিনী কর্তৃক যুদ্ধের উচ্চতর প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত হয়ে তিনি স্কোয়াড লিডারের দায়িত্ব পালন করেন।
পরবর্তীতে সেক্টর কমান্ডার মেজর নাজমুল হকের নেতৃত্বে ৭নং সেক্টরের অধীন চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহর ও শিবগঞ্জের দোররশিয়া, কানসাট, রাধাকান্তপুর প্রভৃতি অঞ্চলে সম্মুখযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন।
১৯৭১ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার কানসাট-কলাবাড়ি সম্মুখযুদ্ধে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী কর্তৃক বুকে গুলিবিদ্ধ হোন। ক্যাম্প হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়ে অল্পকিছুদিন পর মোটামুটি সুস্থ হলে বীর মুক্তিযোদ্ধা এনামুল হক ৭নং সেক্টরের অধীনে, বীরশ্রেষ্ঠ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীরের নেতৃত্বে আবারও চাঁপাইনবাবগঞ্জের বটতলাহাট, চরমহোনপুর, টিকরামপুর, বারোঘরিয়া প্রভৃতি অঞ্চলের সম্মুখযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। মূলত বীরশ্রেষ্ঠ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীরের সহযোদ্ধা ছিলেন তিনি। এছাড়াও, তাঁর সহযোদ্ধা ছিলেন চাঁপাইনবাবগঞ্জের অন্যতম বীর মুক্তিযোদ্ধা দুরুল হোদা, মোফাজ্জল হক, নোমান আলী প্রমুখ।
মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে স্বাধীন বাংলাদেশে তিনি চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও নাচোল থানার ইনচার্জ হিসেবে কিছুদিন দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৯-৮০ সালে তিনি নবাবগঞ্জ মহকুমা আওয়ামীলীগের যুগ্ম-আহ্বায়ক দায়িত্বও পালন করেন। সেই সময় তিনি চাঁপাইনবাবগঞ্জ-১ (শিবগঞ্জ) আসন থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন এবং নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী হন।
সমাজসেবী এবং শিক্ষক হিসেবেও এনামুল হকের সুনাম রয়েছে। এলাকার শিক্ষা বিস্তারে তিনি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। ১৯৮০ সালে চাঁপাইনবাবগঞ্জের কৃষ্ণগোবিন্দপুর কলেজের অর্থনীতির প্রভাষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। পরবর্তীতে চাঁপাইনবাবগঞ্জের রাণীহাটি ডিগ্রী কলেজের প্রতিষ্ঠাতা-অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেন।
বীরশ্রেষ্ঠ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীরের স্মৃতি রক্ষার্থে, তিনি ১৯৮৬ সালে নিজ উদ্যোগে, এলাকার মানুষদের নিয়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জের নারায়ণপুর-সূর্যনারায়ণপুর এলাকায় ‘বীরশ্রেষ্ঠ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর কলেজ (১৯৯৮ সালে কলেজটি নারায়ণপুর থেকে চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহরের স্বরুপনগর এলাকায় স্থানান্তরিত হয়) প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তীতে উক্ত কলেজের প্রতিষ্ঠাতা-অধ্যক্ষ হিসেবে দীর্ঘদিন তিনি দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়াও, চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার শ্যামপুরে মমতাজ মিয়া ডিগ্রী কলেজ ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের মহিপুর ডিগ্রী কলেজ প্রতিষ্ঠায় তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের ডেপুটি কমান্ডার, কার্যকরী নির্বাহী সদস্যসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন। ডায়াবেটিক সমিতির আজীবন সদস্য, প্রবীণ হিতৈষী সংঘের আজীবন সদস্য, রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির আজীবন সদস্য, জেলা মানবাধিকার সমিতির সভাপতিসহ জড়িত ছিলেন চাঁপাইনবাবগঞ্জের বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানে।
জাতীয় দৈনিক পত্রিকা- ডেইলি স্টার, চাঁপাইনবাবগঞ্জ বিজিবি, জেলা জজ শিপসহ স্থানীয় বিভিন্ন সংস্থা/সংগঠন থেকে ‘যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা’ হিসেবে তিনি সংবর্ধিত হয়েছেন। রাষ্ট্রীয় ভাতাপ্রাপ্ত বীর যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা ও সমাজসেবী অধ্যক্ষ.এনামুল হক (ফিটু) ২০১৯ সালের ২৫ অক্টোবর মৃত্যুবরণ করেন।
মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে কবর জিয়ারত, কোরআন খতম, দোয়া ও মিলাদ মাহফিলের আয়োজন করেছে পরিবারবর্গ।